মিরসরাই, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালীসহ বেশির ভাগ উপজেলার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্য চাষিরা। বৃষ্টিতে ডুবে রয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। নষ্ট হচ্ছে সবজি ও রোপা আমন। ভেঙে গেছে বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কায় আতঙ্কে রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। বিভিন্ন জায়গায় বেড়েছে সাপের উপদ্রব। সৃষ্টি হয়েছে পাহাড় ধসের ঝুঁকি।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রাখতে জেলার প্রত্যেকটি উপজেলা, ইউনিয়নের চিকিৎসকদের দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা। মাঠে রয়েছে প্রায় ২৯০টি টিম। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুমও।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামে। আর বৃহস্পতিবার ভোররাত ৩টা পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।
ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে চট্টগ্রামের মিরসরাইতে। পাশাপাশি হচ্ছে পাহাড়ি ঢলও। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৬০ হাজার পরিবার। এ ছাড়া মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার মৎস্য ঘেরের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্য চাষিরা। বৃষ্টিতে ডুবে আছে সবজি ও রোপা আমন। ভেঙে গেছে বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক। অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকা ইছাখালী ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামে জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছেন কয়েক হাজার পরিবার। উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ ইছাখালী খালে একটি বিদেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাঁধ দেওয়ায় এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
ইছাখালী ইউনিয়নের পানিবন্ধি এরফান উল্ল্যাহ বলেন, আমরা আজ প্রায় ৬ দিন পানিবন্দি হয়ে আছি। রান্নাবান্না করা যাচ্ছে না। খুব কষ্টে দিন পার করছি।
উপজেলার মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার মৎস্য চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, এর আগেও বৃষ্টিতে অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে। সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই আবার এখন এই বৃষ্টিতে প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। এছাড়াও এখানকার প্রায় সবাই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
মিরসরাই পৌরসভার বটতল এলাকার পোল্ট্রি ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দিন বলেন, আমার দুটি মুরগির খামারে ৩ হাজার বাচ্চা পানিতে ডুবে মারা গেছে।
মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ জানান, টানা বৃষ্টিতে উপজেলার মৎস্য খামারে বাঁধ ভেঙে অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিন বলেন, মিরসরাইয়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।
এদিকে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে সীতাকুণ্ড উপজেলার উত্তরাংশের ছয়টি ইউনিয়ন। কোথাও হাঁটুপরিমাণ কোথাও কোমর সমপরিমাণ বৃষ্টির পানিতে গেছে অধিকাংশ এলাকা। পানির নিচে তলিয়ে গেছে প্রায় ১৫০ হেক্টর বিভিন্ন ধরনের ফসলি জমি। মাত্রতিরিক্ত পানি স্রোতের কারণে ভেঙে গেছে উপজেলার বাঁশবাড়ী ইউনিয়নের সিকদার খালের স্লুইসগেট। দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী এস এম তারেক বলেন, সীতাকুণ্ডে উপজেলার মধ্যে মোট ১৮টি স্লুইসগেট আছে। তার মধ্যে চারটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো এতদিন ধরে কোনোভাবে জোড়া তালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাঁশবাড়িয়া এলাকার সিকদার খালের স্লুইসগেটটি অনেক আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ছয় বছর আগেও এটি একবার ভেঙে যায়।
সীতাকুণ্ড উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, উপজেলার বারৈয়ারঢালা, সৈয়দপুর, মুরাদপুর ইউনিয়নের সব কৃষিজমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া পৌরসভা, বাড়বকুণ্ড ও বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আংশিক কৃষিজমি তলিয়ে গেছে।
এদিকে ভারী বর্ষণ আর কর্ণফুলী নদীর জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার নিম্নাঞ্চলও। অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ডুবে গেছে ফেরিঘাটসহ নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহ। জোয়ারের পানিতে ফেরিঘাট প্লাবিত হওয়ায় বুধবার (২১ আগস্ট) দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ফেরি পারাপার বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেরির পরিচালক সাইদুর রহমান।
এদিকে নদী তীরবর্তী কধুরখীল, পশ্চিম গোমদণ্ডী, শাকপুরা ঘোষখীল, পশ্চিম শাকপুরা এলাকা প্লাবিত হয়ে ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। বাড়ির উঠোনে হাঁটুসমান পানি।
পৌরসভা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম গোমদণ্ডী চরখিদিরপুর গ্রামের প্রকাশ বড়ুয়া ও সজল বড়ুয়া বলেন, দুপুর থেকে জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। বাড়ির উঠোনে হাঁটুসমান পানি।
অন্যদিকে কয় দিনের লাগাতার বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে হাটহাজারী উপজেলার আওতাধীন নিম্নাঞ্চলে। কুমারী খালের বাঁধ ভেঙে ঢলের পানি ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। যে কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে সরকারহাট-নাঙ্গলমোড়া সড়কে। মিঠা ছড়া, আলাওল ছড়া, সোনাই মনাই, ধলই খাল, বদর খালী, কাটখালী খাল ও ছড়ায় ঢলের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে।
ফটিকছড়ি উপজেলায় অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে শতাধিক গ্রাম বর্তমানে পানির নিচে নিমজ্জিত রয়েছে। হালদা নদী এবং ধুরুং খালের পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গহিরা-হেয়াকো সড়কের পাইন্দং, নারায়ণহাট, নাজিরহাট-কাজিরহাট সড়কের সুয়াবিল এলাকা, কাটিরহাট-সমিতিরহাট ও নানুপুর সমিতির হাটের সংযোগ সড়কসহ কয়েকটি স্থান কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ। গত ২০ আগস্ট থেকে এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে বর্তমানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে উপজেলা নাজিরহাট পৌরসভার হালদার বাঁধ। এ এলাকার মালেকার পাড়া এলাকায় বাঁধ প্রায় ভেঙে গেছে। যেকোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে প্রায় ১৫০ বসতঘর।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, অতিভারি বৃষ্টির কারণে ফটিকছড়ির বিভিন্ন স্থানে খালগুলো উপচে লোকালয়ে প্লাবিত হচ্ছে। ধুরং খাল বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
এদিকে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, অতি বর্ষণের কারণে মহানগরসহ উপজেলাসমূহের বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধসহ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই চট্টগ্রাম জেলার ২০০ ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট ২০০, এ ছাড়া ১৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রত্যেকটিতে ৫টি করে মোট ৭৫টি, ৯টি আরবান ডিসপেন্সারির প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট ৯টি, একটি স্কুল হেলথ ক্লিনিকে একটি ও জেলা সদর হাসপাতালে (চট্টগ্রাম ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল) ৫টি মেডিকেল টিমসহ সর্বমোট ২৯০টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাকিব হাসান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সড়ে আসতে মাইকিং করা হচ্ছে।